Ekhon Bangla

নারী সমাজের রাত দখল

কলমে – অধ্যাপক পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায় (প্রাক্তন অধ্যাপক, অসম বিশ্ববিদ্যালয়)

পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটলো ১৪ই আগসট, ২০২৪ মধ্যরাতে। কলকাতার আরজি, কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসক- ছাত্রীর কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষণ ও খুন / খুন ও ধর্ষণের শিহরিত ঘটনা যা ‘আত্মহত্যা’ বলে সরকারী কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছিলো তার প্রতিবাদে পশ্চিম বাংলা জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কোনও দলীয় বৃত্তের বাইরে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে ও একজন ‘নাগরিক’ হিসাবে রাস্তায় নামলো মেয়েরা সারা রাত ধরে, নাম দিলো ‘রাস্তা দখল’ নয়, ‘রাত দখল’।

নারীদের বলা হতো ‘অর্ধেক আকাশ’, তাই দিবারাত্রির অর্ধেক ‘রাতের’ দখল এক নতুন ধাঁচের নারীবাদের জন্ম দিলো। ঘরের বাইরে বেরিয়ে গৃহিণী থেকে ‘ব্যক্তি- নাগরিক’ পরিচয়ে একা ব্যক্তি-নারী বেড়িয়ে পথে নামলো- “পথে আবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা।” পুরুষতন্ত্রের বাঁধনহীন এক নারীবাদী জনস্রোত দেখা গেল- যা পুরুষ-বিরোধী নয়, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর বিরুদ্ধে এক স্বত:স্ফূর্ত নারীবাদী আন্দোলন যা রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতকে ঐ রাতেই নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তাই ঐ নারী জাগরণের ঢেউয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী স্লোগান দেন- ‘অপরাধীর ফাঁসি চাই’। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদক ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীকে ছাপিয়ে গিয়ে বললেন, অপরাধীকে ‘এনকাউন্টার’ করে মেরে ফেলতে হবে’। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কিংবা সাংসদ হিসাবে যে এই কথা বলা যায় না এটা তাঁরা ভুলে গেলেন- এমনই ঐ রাতের নারীবাদী আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিলো, এ যেন হীরক রাজার দেশের সিনেমায় ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান- খান’ এর দৃশ্য।

সরকারী আর জি. কর হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সামাজিক গণমাধ্যমের প্রচারে যে ‘রাত দখল’ হওয়ার কথা ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের দু’ এক জন ছাত্রীর ডাকে কলকাতা শহরের মাত্র তিনটি জায়গায় যাদবপুর, একাডেমী অফ ফাইন আর্টস প্রাঙ্গণ এবং কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে (নেহাতই ছাত্র আন্দোলনের ডাক) তা স্ফুলিঙ্গ থেকে মূহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো সারা পশ্চিমবঙ্গে পাহাড় থেকে সাগরে, গ্রাম- শহর, নগর- প্রান্তরে সামাজিক মাধ্যমে লাখে লাখে মানুষ নির্দলীয় ভাবে ‘নাগরিক- সমাজের’ আকারে রাতে নামলেন- একটাই আওয়াজ, ‘ন্যায়বিচার চাই’ ‘We Want Justice’। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সারা দেশে, সারা ভারতে এবং দেশান্তরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা ‘Justice for R.G. Kar’ এর আন্দোলনে যোগ দিলেন। এহেন আন্দোলন অসংগঠিত কিন্তু সংঘটিত এবং শান্তিপূর্ণ চলমান নারী আন্দোলন কেউ কখনো আগে দেখেন নি। অবশ্য সামাজিক মাধ্যমের ঢেউ এর আগে কখনও এমন জোরালো ও ব্যাপক ভাবে ছিল না। কলকাতায় আজকের ‘রাত দখল’ নামক নারীবাদী আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম কারণ যে ‘সামাজিক মাধ্যম’ একথা নি:সন্দেহে বলা যায়।

নারীবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি আর.জি, করের চিকিৎসক ছাত্রীর উপর নৃশংস অত্যাচার ও মৃত্যু এবং ঐ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার সরকারী (অবশ্যই রাজ্য সরকার) চেষ্টার বিরুদ্ধে আরজি, কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের নির্দলীয় সমবেত আন্দোলন যেভাবে চলছে তার ফলে নারীদের ‘রাত দখল’ আন্দোলন দেশে নারী সুরক্ষার এবং প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষার আন্দোলনে পর্যবসিত হয়ে সারা দেশে এক বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরী করেছে।

আজ ঐ বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরী হওয়ার পিছনে ‘নাগরিক সমাজের’ ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘সুশীল-সমাজ’ বা ‘নাগরিক সমাজ’ বলা হচ্ছে এই কারণে যে ‘রাত দখল’ আন্দোলন চিকিৎসক-ছাত্র আন্দোলনকে এক ব্যাপক ‘সামাজিক- আন্দোলনে’ পরিণত করেছে। কিন্তু এই আন্দোলনে গণ-জাগরণ ঘটলেও এই আন্দোলন এখনও পর্যন্ত ‘গণ-আন্দোলনে’র রূপ পরিগ্রহ করেনি। কারণ, সেই আন্দোলন হচ্ছে ‘গণ-আন্দোলন’ যেখানে কৃষক-শ্রেণী ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে ‘নাগরিক সমাজ’ বা “Civil Society” র কাজ হচ্ছে সরকারের উপর চাপ দিয়ে নিজ দাবী পূরণ করা, সরকার পরিবর্তন করা বা নূতন সরকার গঠন করা নয়। সরকারের সর্দ্ধক বা ইতিবাচক কাজকে সমর্থন করা হচ্ছে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসাবে ‘নাগরিক সমাজে’র কাজ।

আর জি. কর হাসপাতালের ছাত্র-ছাত্রীদের ‘অভয়া’ বা ‘তিলোত্তমা’ বা ‘কাদম্বিনী’ র ‘ন্যায় বিচারের’- “We Want Justice” এর দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলন হচ্ছে Single Issue Movement। কিন্তু এই আন্দোলন যদি Multiple Issue Movement – এ পরিণত হয় তাহলে গতিমুখ অন্যদিকে চলে যাবে- সর্তক থাকতে হবে ‘মৌলবাদীরা যেন প্রতিবাদের দখল না নিতে পারে।

আর জি. কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন থেকে উদ্ভুত ‘রাত দখলে’র ‘নূতন নারীবাদী আন্দোলন’ জয়যুক্ত হউক এবং ধূনিত হউক “Personal is Political” I

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *