Ekhon Bangla

শহরের গতি সঞ্চারে নয় কাটমানির গতি বাড়াতেই ট্রামের মৃত্যু ঘণ্টা

লেখক – ডঃ পার্থ প্রতিম বিশ্বাস (অধ্যাপক – নির্মাণ প্রযুক্তি বিভাগ , যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় )

সম্প্রতি রাজ্য সরকার চিরতরে শহর কলকাতার রাজপথ থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজ্যের তৃনমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উত্তরোত্তর ট্রামের রুট এবং সংখ্যা কমিয়ে আনছিল । অবশেষে এবার রাখ ঢাক না করেই সরকারের স্পষ্ট ঘোষণা ট্রাম তোলার পক্ষে। কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান এই টুকু দূরত্বে প্রতীকী ট্রাম চলবে শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী কলকাতার মতো গতিমন্দার শহরের রাস্তায় বাড়তি গতির সঞ্চারের লক্ষ্যেই সরকার ট্রামের বিদায় ঘণ্টা বেজেছে । ফলে গত দেড়শো বছর ধরে চলে আসা ট্রামের সাথে শহরের বিচ্ছেদে স্বাভাবিক কারনেই পরিবেশপ্রেমী মানুষ , ট্রাম শ্রমিক সংগঠন সহ নাগরিক সমাজ মুখর হয়েছে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কার্যত শহরের বৃহত্তর নাগরিক সমাজ, ট্রেড ইউনিয়ন , প্রযুক্তিবিদ , গনযান বিশেষজ্ঞ , নগর পরিকল্পনাবিদ ,অর্থনীতিবিদ অথবা পরিবেশবিদ কারোর সাথে কোন মত বিনিময় ছাড়াই ট্রাম তুলে নেওয়ার একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে সরকার। এমনকি গত ডিসেম্বর মাসে, এই বিষয়ে এক জনস্বার্থ মামলায় হাই কোর্টে ট্রামকে পিপিপি মডেলে চালানোর জন্য যে পর্যবেক্ষণ ছিল আদালতের , সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে সেটাও নস্যাৎ হয়েছে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশীদার ট্রাম

কলকাতার ইতিহাসে এই ট্রাম কখনোই একটা ইস্পাতের প্রাণহীন যান ছিল না । উপরন্তু কালে কালে এই ট্রাম হয়ে উঠেছিলো শহরের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদান। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার রাজপথে ট্রাম শ্রমিক আন্দোলন এই রাজ্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী। এমনকি কলকাতার ছেচল্লিসের ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিহত করতে ট্রাম শ্রমিকদের ভূমিকা শহর কলকাতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী। আজকের ‘ মেগা সিটি ‘ নামে চেনার বহু আগেই এই শহরকে নিয়ে সেলুলয়েডের পর্দায় ‘ মহানগর ‘ সৃষ্টি করেছিলেন সত্যজিত রায় । কলকাতা শহরের বিপুলায়নকে বোঝাতে পরিচালক সেই চলচ্চিত্রের শুরুর দু মিনিট টানা ব্যবহার করেছিলেন চলমান এক ট্রামের দৃশ্যপট। সত্যজিতের চোখে কখনও শহর কলকাতায় ফিরে আসা অপুর কাছে ট্রাম ছিল তাঁর স্বপ্ন থেকে বাস্তবে উত্তরনের স্থান আবার কখনও ঋত্বিক ঘটকের ‘ বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘ যাওয়ার পথে শহরের রাস্তায় ট্রাম হয়ে উঠেছিলো এই নগর সভ্যতার যান্ত্রিক সংস্করণ। ‘ আর কি বা দিতে পারি – পুরনো মিছিলে পুরনো ট্রামেদের সারি ‘ – কিংবা ‘ চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন ‘ এই শহরে ট্রাম আর প্রেমকে এক সুরের বন্ধনীতে এনে ফেলেছে।

বিকৃত নগরায়নের গ্রাসে ট্রাম

সন্দেহ নেই শুধু এই শহর নয় , বোম্বাই থেকে ভাবনগর কিংবা কলকাতা থেকে মাদ্রাজ পথে নেমেছিল ট্রাম সদ্যোজাত নগরায়ন ভাবনায় উন্নত পরিবহনের তকমা নিয়েই। কিন্তু এদেশে অপরিকল্পিত নগরায়নের ধাক্কায় বিপর্যস্ত পরিবহন ব্যবস্থার বলি হতে হয়েছে ট্রামকে। ট্রাম শুধু কলকাতার রাজপথে নয় , পৃথিবী জোড়া প্রায় সাড়ে চারশো বড়ো বড়ো শহরে এখনও ট্রাম চলে নিত্যদিনের গনপরিবহণের দায় সামাল দিতে। এমনকি করোনা অতিমারি উত্তরকালে পৃথিবীর দুই শক্তিমান রাষ্ট্র চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গন পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রামকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। ট্রাম শহরকে গতিহীন করে তোলে এমন যুক্তির জালে ফেলে শহর থেকে ট্রাম খেদানোর পরিকল্পনা শুরু। কিন্তু এই অপরিকল্পিত নগরায়নের যুগে গতিহীন হয়ে উঠছে কেন এক একটা আস্ত শহর তার কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ না করেই চটজলদি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে তোলা হল ট্রাম, নামলো পথে বাস। সন্দেহ নেই বাসের গতি ট্রামের তুলনায় ঢের বেশি । কিন্তু সেই গতিমান বাস যানজটে অবরুদ্ধ শহরের কোন রাস্তায় গতির বহর দেখিয়ে ছুটবে সেই প্রশ্নের উত্তর রয়ে গেলো অধরা অথচ ট্রাম বিদায় নিলো।

দূষণহীন গন পরিবহণ – ট্রাম

কলকাতা শহরের এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী মানুষ । এর সাথে এই শহরে গড়ে তিরিশ লক্ষ মধ্য এবং নিম্ন বিত্ত নিত্য যাত্রী শহরে আসে জীবন জীবিকার তাড়নায়। এমনকি দেশের অন্যান্য মেগা সিটির তুলনায় কলকাতা শহরের মানুষের মাথা পিছু আয় তুলনায় কম। ফলে এমন শহরে পরিবহন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুলভ গন পরিবহণ অত্যন্ত জরুরি। আর সেই জরুরি ব্যবস্থায় সরকারি পরিবহন হিসাবে ট্রাম হতে পারে এক অন্যতম বিকল্প। কিন্তু সরকারি নীতিতে সুলভ ট্রাম কিংবা বাস উভয়েরই অমিল। প্রতিদিন এই মুহূর্তে শহরে ৮০% এর বেশি বাস রাজপথে চলে বেসরকারি মালিকানায়। যাত্রী পরিবহনে বেসরকারি বাস চলে দিনান্তে লাভের কড়ি মালিকের ঘরে তুলতে। ফলে উত্তরোত্তর বাসের ভাড়া বেড়ে যায় জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি আর চালক বাস কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে । বাসের ভাড়া বাড়লে যাত্রীদের বিপদ আর ভাড়া না বাড়লে লোকসানের ভয়ে বাস পথে না নামার বিপদ । এমন জোড়া সংকটে এবং সরকারি নীতি পঙ্গুত্বে ঊর্ধ্বমুখী জ্বালানীর ধাক্কায় বাস নির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে । আর এই সময় বিকল্প হিসাবে বেড়ে চলেছে ছোটো দু চাকার গাড়ি আর চার চাকার গাড়ির সংখ্যা শহরের রাজপথে। বিশেষত ই-কমার্স আর পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধিতে বেড়েছে ছোট গাড়ীর সংখ্যা শহর জুড়ে। আর এই বাড়তি ছোট গাড়ির ধাক্কায় বাড়ছে হু হু করে শহরের বায়ু দূষণ । এই প্রেক্ষিতে দূষণ হীন গন পরিবহন হিসাবে ট্রামের জুড়ি মেলা ভার অথচ সেই ট্রামকেই বলির পাঁঠা করা হল। শহরের রাস্তায় ডিজেল পোড়া ধোঁয়ার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে আজ নতুন আঙ্গিকে ভাবা প্রয়োজন শহরের রাস্তায় পরিবেশবান্দভ যান হিসাবে ট্রামকে। এখনকার আধুনিক শহর পরিকল্পনায় ‘ গ্রিন সিটি ‘ কিংবা ‘ ক্লিন সিটি ‘ সবেতেই এখন পরিবহণের প্রয়োজনে সীমিত শক্তির ব্যবহার প্রস্তাবিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে শক্তি ব্যবহারের নিরিখে যাত্রী পিছু সবচেয়ে কম শক্তি খরচ হয় বাইসাইকেল এবং ট্রাম সেই তালিকায় তৃতীয় । এমনকি মেট্রো রেলের তুলনায় জ্বালানী খরচে আশি শতাংশ সাশ্রয়ী হল ট্রাম । ফলে জ্বালানী খরচের ভিত্তিতে শহরের রাস্তায় ট্রামের জুড়ি মেলা ভার।

গতিমন্দা কারন ট্রাম ?

কলকাতা শহরে রাস্তার পরিমাণ শহরের মোট ভৌগোলিক এলাকার মাত্র ৬%। যেটা পরিকল্পিত বড় শহরের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত নিদেনপক্ষে ২০-২২% । শহরে রাস্তা বাড়ার পাঁচগুণ বেশি লয়ে বাড়ছে ছোট গাড়ি । ফলে ভয়াবহ যান ঘনত্বের কারনে কলকাতার রাস্তায় ব্যস্ত সময়ে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ১২-১৪ কিলোমিটার । ফলে এমন গতিহীন শহরে যে ট্রাম গতিমন্দার মুল কারন এটা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমান করা যাবে না। ফলে সীমিত রাস্তায় বেলাগাম গাড়ী কলকাতার রাস্তায় গতিমন্দার সবচেয়ে বড় কারণ । পাশাপাশি একই রাস্তায় ভিন্ন ভিন্ন গতির যানবাহনের সহাবস্থান শহরকে গতি কমিয়ে তোলে। শহরের রাজপথে যদি একসাথে রিক্সা , অটো থেকে শুরু করে বাস , ট্রাম চলে সেই পথ, নিরাপত্তার নিরিখে ঝুঁকি প্রবণ হয়ে ওঠে এবং গতিহীনটার জন্ম দেয়। এদেশের কম বেশি প্রতিটি শহর এই রোগে আক্রান্ত। শহরের রাস্তায় ট্রাম চলে সমান্তরাল পথে ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে । ফলে অন্য যানবাহন ট্রামের লাইনে এসে ঢুকে পড়েই মুলত যানজট তৈরি করে। অন্যের যাত্রাপথে ট্রামের নাক গলানোর সুযোগ কম অথচ যানজটের অজুহাতে ট্রাম তুলে দেওয়া হল। ফলে ট্রামের ধীর গতির কারণে যানজটের চেয়ে ঢের বেশি দায়ী বেআইনি ঢঙে যান চলাচল ।নগরায়নের ধাক্কায় শহরে বেড়ে চলা যানবাহনের দুই তৃতীয়াংশ হল ব্যাক্তিগত ছোট গাড়ী। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত না ছোট গাড়ীর এই বিপুল সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শহরের রাজপথে ততদিন যানজট , গতিমন্দা এবং দূষণ একে অন্যের হাত ধরাধরি করেই থাকবে। এমন প্রেক্ষিতে সব ব্যাটাকে ছেড়ে ট্রামকে শত্রু হিসাবে দাগিয়ে উন্নত পরিবহন গড়ে তোলার পরিকল্পনা খানিক মরিচিকার মতোই।

পাখির চোখ ট্রামের জমি

এই প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য যে একটা ঐতিহাসিক শহরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাঁর ঐতিহ্যের অংশীদার হয়েই। আর সেই শহরকে বাঁচিয়ে রাখার দায় রাজ্যের সরকার এবং শহরের পুরসভার। যে কারনে শহরে টাউন হল কিংবা ভিক্টোরিয়ার মতো স্থাপত্যের সংরক্ষন প্রয়োজন হয় ঠিক সেই কারনেই দার্জিলিঙের টয় ট্রেন কিংবা কলকাতার ট্রামের সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। বয়সের ভারে ক্লান্ত স্থাপত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর বিকল্প প্রয়োজন ঠিক তেমনটাই কাঙ্খিত ট্রাম সচল রাখতে উপযুক্ত পরিকল্পনা। এই প্রেক্ষিতে শহরের গতিমন্দার সহজ বিকল্প হিসাবে ট্রামকে বলির পাঁঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আসলে গতিহীনটার দোহাই দিয়ে শহর জুড়ে ট্রামের জমি – ডিপো সহ যাবতীয় সম্পদ বেঁচে দেওয়ার পথে নেমেছে সরকার। ইতিমধ্যে শহরের বিভিন্ন রুটে ট্রাম তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের অব্যবহিত পরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাজ্যের প্রশাসন যে ভাবে জলের দরে ট্রাম কোম্পানির জমি বাড়ি বিক্রি করেছে তাতে ‘ ডাল মে কুছ কালা’ থাকার গন্ধ পাচ্ছে সাধারন মানুষ। কারন সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জমি যেভাবে হাত বদল হয়ে গেছে শাসক দলের নেতা, মন্ত্রি এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট বাহিনীর হাতে , তাতে এবার যোগ হচ্ছে ট্রামের জমি- বাড়ি -সম্পদ। সরকারি সম্পদ এভাবেই হাত বদলে বেসরকারি হাতে যাচ্ছে আর কাটমানির ঘুরপথে কোটি কোটি টাকার ভাগ লুটে পুটে খাচ্ছে শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা । ট্রাম তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল করেছে শাসক। একদিকে সরকারের রাজকোষ থেকে সরকারি পরিবহনের দায় ঝেড়ে ফেলা আর পাশাপাশি ট্রামের সম্পদ বেঁচে পরিবহন বায়ের ঘাটতি কমানো আর উপরি জুটল চৌখশ নেতা মন্ত্রিদের ইনাম সরকারি সম্পত্তির হাত বদলে।

আসলে ট্রাম তুলে দেওয়ার বিপদ আশু টের না পেলেও এর কড়া মুল্য চোকাতে হবে শহরের মানুষকে আগামি দিনে। ফলে সঙ্গত কারনেই ট্রামের শ্রমিক সংগঠনের সাথে জোট বেঁধে কলকাতাপ্রেমী নাগরিক সমাজ আজ পথে নেমেছে। মনে রাখতে হবে এই শহরের ঐতিহ্যের সাথে শহরের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আজ এক সারিতে পড়ে গেছে ট্রামের বিদায় ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে। ফলে সরকারের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে আরও বেশি মানুষের সক্রিয়তা চাই ট্রামের পুনুরুজ্জিবনের দাবিতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *