Ekhon Bangla

অন্ধা কানুন নয় জাস্টিস মিলবে খোলা চোখে

লেখনী — সুবল সর্দার, অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্ট অফিসার, ক্যালকাটা হাইকোর্ট

“ইয়ে অন্ধা কানুন হ্যায়। বাতোঁ অউর দলিলো কা, ইয়ে খেল হ্যায় ওকিলো কা”। বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানো গানটি চর্চিত লোকমুখে। সত্যিই তো এত দশক ধরে সুপ্রিম কোর্টের চোখ বাঁধা আইনের জেরে যারা জাস্টিস পায় নি, তাদের কি হবে? কালো বাঁধন থাকায় কি আগের বিচার সব অন্ধ ছিল! স্ট্যাচুর বন্ধ চোখ খুলে দিলে বিচারের চোখ দ্রুত খুলে যাবে? চোখ বন্ধ করার অপব্যবহার হচ্ছে বলেই কি বাঁধন খুলে দেওয়া? খোলা চোখে জমে থাকা বিচারের তেজ কি ন্যায়ের পথকে শক্তিশালী করবে? তাহলে বিচারপদ্ধতি নিয়ে এত পোস্ট মর্টেম কেন! ‘জাস্টিস ডিলেড’ জনগণ চায় না, খোলা চোখে দ্রুত বিচার জনগণ প্রত্যাশা করে।

আমাদের সংবিধান চালু হয় ১৯৫০ সালে ২৬ শে জানুয়ারি। তার অনেক বছর পর ১৯৭৮ সালে বিখ্যাত ভাস্কর শিল্পী চিন্তামণি কর সুপ্রিম কোর্টে কালো ব্রোঞ্জের নির্মিত স্ট্যাচুর ( যাকে আমরা ‘লেডি অফ জাস্টিস ‘বলছি) এক অপূর্ব ভাস্কর্য উপহার দেন । সেখানে ওই ‘লেডি অফ জাস্টিসে’র কোলে এক শিশু,তার হাতে খোলা আইনের বই। এখন প্রশ্ন পুরুষ শাসিত সমাজে কিভাবে মহিলা স্ট্যাচু? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরের উক্তিকে অনুসরণ করি ‘দন্ডিতের সাথে দন্ডদাতা যখন সমভাবে কাঁদেন তখন বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়’। বিচার মানে শুধু কঠোরতা নয়, কোমলতাও । এই কোমলতা বোঝাতে ‘লেডি অফ জাস্টিসে’র পরিকল্পনা আসে। এখন জানব আগে কি ছিল আর এখন কি হয়েছে যেমন ছবিতে দেখা যাচ্ছে। প্রথমে কালো থেকে সাদা হয় বিচারের দেবীর। তার শ্বেত শরীর,চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে , একহাতে দাঁড়িপাল্লা আর অন্য হাতে তরোয়াল। কালো কাপড় মানে শোকের প্রতীক। চোখ বাঁধা নিরপেক্ষতার। কোন দিকে না তাকিয়ে তৃতীয় নয়ন দিয়ে নিরপেক্ষ রায়দানের কথা মনে করা হয়। দাঁড়িপাল্লা মানে কোনো পক্ষে নয় শুধু বিচারের পক্ষে এমনটাই বোঝায়। অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে দেবী দুর্গার মতো বিচারের দেবীর হাতে তরোয়াল। এখন জানব কালো থেকে সাদা কেন দেবীর অবয়ব? অন্ধকার থেকে আলোর পথে বিচারের ন্যায় দন্ড পরিচালিত হয়। দিনের আলোর মতো স্বচ্ছতা বিচারের বাণী, তাই সাদা হয়। কিন্তু কালো ছিল কেন? অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে দুঃখে দেবী কালো হয়ে যান। ঠিক যেমন প্রলয়নাথ প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সমুদ্রের হলাহল পান করে নীলকন্ঠ হয়ে যান। অর্থাৎ আমাদের বিচারের দেবীর ধ্যান ধারণা আমাদের ঐতিহ্য -কৃষ্টি-সংস্কৃতির ধারক। কলোনিয়াল ছাপ কোন কালেই ছিল না। আমাদের ভারতীয় ভাবধারায় সম্পৃক্ত দেবী মূর্তি। তরোয়াল যে আমাদের ঐতিহ্য বহন করে তারও এক কারণ আছে। ভাস্কর চিন্তামণি করের দেবী মূর্তির ওই ভাস্কর্য সংস্কার করে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের লাইব্রেরীতে নতুন মূর্তি বসে। যার এক হাতে দাঁড়িপাল্লা ,অন্য হাতে তরোয়াল।

ভারতবর্ষে প্রথম হাইকোর্ট হল ক্যালকাটা হাইকোর্ট। শহরের সর্বত্র নাম বদলে কলকাতা হলেও হাইকোর্ট ক্যালকাটাতেই আছে। ক্যালকাটা হাইকোর্টে শেরিফের হাতে ন্যায় দন্ডের সাথে তরোয়াল আছে যা এখনও শেরিফের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়। এখনও পর্যন্ত দেশের প্রাচীনতম হাইকোর্টের দেবী মূর্তির কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে আছেন বিচারের দেবী। দেখা যাক দেবীর কখন চোখ মেলে।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় দেবীর চোখ খুলে দিয়েছেন। বিচারব্যবস্থায় দ্রুততা আনতে এই পদক্ষেপ। দেবীর চোখ, মুখ আমরা এখন ভালো করে দেখতে পাব। তরোয়াল পরিবর্তনে আইনের বই থাকবে যা প্রথমে ছিল। দেবীর হাতে এখন থেকে অসুর বিনাশী সেই তরোয়াল থাকছে না। দাঁড়িপাল্লা যেমন ছিল থাকবে। বিচারের দেবীকে দেখতে পাব কিন্তু সে আমাদেরকে দেখতে পাবে কী ? শুরুতেই যেটা বলেছিলাম স্ট্যাচুর সংস্কার হচ্ছে কিন্তু বিচার ব্যবস্থার সংস্কার কবে হবে? চিন্তমনি করের ভাস্কর্য কখনো পরিবর্তন করা যায়? বিচার ব্যবস্থা বিচার সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বোঝে কিন্তু বিচারের দেবীর এতো ভাস্কর্য মন্ডিত গরিমা কী করে বুঝবে! নতুন ন্যায় সংহিতা নিয়ে আমাদের আনন্দ হওয়ার কোন কারণ দেখি না, যদি না বিচার দ্রুত পাওয়া যায় । এখনও লোকমুখে শোনা যায় আমি কোর্টে দেখে নেব। অর্থাৎ আদালতের প্রতি আস্থা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বিলম্বিত বিচার নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা। কেউ জানে না কবে অভয়া বিচার পাবে, আদৌও কি পাবে? এখানে কেসের উৎপত্তি আছে নিষ্পত্তি নেই। তাই সারা দেশে, সুপ্রিম কোর্ট সহ আমাদের ক্যালকাটা হাইকোর্টে লক্ষাধিক মামলার পাহাড় জমে আছে। দ্রুত বিচার পেলে দেবীর চোখ খুলে যাবে। তাই কালো কাপড় খুলে দেবীর চক্ষু দান নিষ্প্রয়োজন। গতানুগতিক পথে অলঙ্করণ ছাড়া বিচার ব্যবস্থায় তাঁর অবদান শূন্য। পূর্বসূরীর মত রাজনীতির পথ উন্মুক্ত রাখতে এই পরিবর্তন নাকি বিচারব্যবস্থার জটিলতা দূর করতে সংস্কার, সময় বলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *