Ekhon Bangla

উৎসবের অন্তরালে যখন পুঞ্জিভূত দ্রোহকাল

কলমে – ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য [অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং অ্যাসোসিয়েট ফেলোইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস) সিমলা, হিমাচল প্রদেশ]

মানুষ, সমাজ, শাসনযন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা … সকলেরই প্রাণভোমরা বাঁধা পড়ে আছে অমোঘ সময়ের হাতে। সময়ের অকপট তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় আস্ত একটা সফল কিংবা ব্যর্থ জীবন। ধুলোবালির বুকে ধরিত্রী আঁকড়ে কেবল পড়ে থাকে জীবনের গায়ে এঁকে যাওয়া অসংখ্য সাদাকালো দাগ।

এক অস্থির সময় অতিক্রম করছি আমরা। যখন উৎযাপনের অন্তরালে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে রাশি রাশি ক্ষোভ। যখন উৎসবকালের আবরণে ঘাপটি মেরে আছে অদম্য দ্রোহকাল। যে সময়কালে মিছিলে, স্লোগানে, জন-জাগরণে বিদ্ধ স্বৈরাচারী শাসক। কিন্তু গণতন্ত্রের খোলসের আড়ালে একটু একটু করে প্রতিদিন বদলে ফেলা হচ্ছে রাষ্ট্র চরিত্র। মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার মৃত শামুকের খোলসে গুটিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় সুবন্দোবস্ত রাতারাতি নির্মাণ করে ফেলা হয় রাষ্ট্রশক্তির দাপটে। গণতন্ত্রের পরিসর ক্রমসঙ্কুচিত করার সমস্ত ফন্দিফিকিরই চলে ‘মানুষের’ নামে জয়ধ্বনি দিয়েই! বদলে ফেলা রাষ্ট্র চরিত্রের খঞ্জরে স্বৈরাচারী অভিলাষের উল্লাস খলবল করে ওঠে।

সমাজ-জীবনের খাঁজে খাঁজে গজিয়ে ওঠে দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার ও স্বজনপোষণের অসংখ্য বিষবৃক্ষ। রাষ্ট্রীয় মদতে সেই বিষবৃক্ষ রাতারাতি হয়ে ওঠে নিয়মের প্রতিলিপি। সেই বিষবৃক্ষ-জাত ফুল-ফল-বাকলে সমৃদ্ধ হয় রাষ্ট্রশক্তির গা ঘেঁষে লেপটে থাকা বেশ কিছু উচ্ছিষ্টজীবী। মানুষে মানুষে বিভাজনের পাটীগণিতের নির্ভুল অংক কষে ফেলা হয় সঘন গহন রাতগভীরের আবডালে। গোটা সমাজ-জীবনের গা বেয়ে চলকে পড়ে পুঁজ-রক্ত-ক্লেদ।

রাষ্ট্রের তূনে গচ্ছিত রাখা আইনের অপপ্রয়োগের স্তূপ ঝলমলিয়ে ওঠে উদ্ধত অট্টহাসিতে। দুর্বিনীত শাসকের দর্প-উল্লাস আছড়ে পড়ে ধুলায় ঢাকা জীবনের আদিগন্তে। প্রতিবাদী আমজনতার মুষ্টিবদ্ধ হাত অবশ হয়ে আসে রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তির অসহনীয় নিষ্পেষণে। তবু ভোট বাক্স স্ফীত হয় গুঢ় রাসায়নিক সমীকরণে। তথাপি ভরপুর ভোটবাক্সের আনাচে কানাচ বেয়ে গলে পড়ে মৃত প্রজাপতির পাখার অব্যক্ত শোক! অবনত অসহায় মানুষ, সমাজ, গণতন্ত্র, দূর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক তামাশা দেখে কেঁপে কেঁপে ওঠে।

মানুষ তবু ছুটে চলে শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে। কোন এক অজানা বোধের তাড়নায় লক্ষ মানুষের সংবেদনশীল হৃদয় জোট বাঁধে। রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার স্পর্ধা সংক্রামিত হয় মুষ্টিবদ্ধ মননে। মিছিলে-স্লোগানে-আবেগে-তরঙ্গে স্বৈরাচারকে পলে পলে বিদ্ধ করে। শপথের আগুনে সেঁকা মানববন্ধনের বল্গাহীন ঢেউ আছড়ে পড়ে রাজপথে, নগরে, প্রান্তরে।

আশংকা ছেয়ে ফেলে উৎকণ্ঠিত রাষ্ট্রীয় দরবার-ময়। উদ্ধত রাষ্ট্র প্রত্যাঘাতের সুযোগ খোঁজে। হাটে, মাঠে, ঘাটে ছড়িয়ে দেয় শাসকের রোদচশমার রঙে আঁকা অসংখ্য অনুগত প্রচারযন্ত্রীদের। তবু শঙ্কা কমে না। অসহিষ্ণু রাষ্ট্রশক্তির রোষানল ওঁত পেতে থাকে প্রতিবাদী তরঙ্গকে এক লহমায় তছনছ করে ফেলার গুঢ় অভিপ্রায়ে।

প্রায় এক শতক কাল ধরে কবরে ঘাপটি মেরে থাকা ইতালীয় দার্শনিক ‘আন্তেনিও গ্রামশি’ সহসা যেন কবরের ফাঁক গলে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন …… “The old world is dying and the new world struggles to be born; now is the time of monsters”! সময়ের ঘড়ি টিকটিক করে বার্তা পাঠায় অজানা নতুন দিগন্তের। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, দ্রোহে উদ্বেলিত তরঙ্গায়িত জনকলরব। উপসংহারটা লেখার জন্য কলম হাতে নিশ্চুপে প্রতীক্ষারত অমোঘ সময়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *