কলমে – অনিন্দ্য রায় চৌধুরী ( আইনজীবী ও কংগ্রেস মুখপাত্র )

রামায়ণ অনুসারে, রামচন্দ্রের পক্ষ নিয়েছিলেন বিভীষণ। রাবণ বধের পর লঙ্কার সিংহাসনে বসেছিলেন ‘ঘর-শত্রু’ বিভীষণ। পাঠকরা ভাবতেই পারেন, বাংলার শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখতে বসে বিভীষণ প্রসঙ্গ নিয়ে আসার কারণ কী? আসলে ক্ষমতা দখলের জন্য যে স্বার্থান্বেষী বিভীষণদের দেখা মেলে আজও, তার প্রমাণ এই বাংলা শাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসটাই। ২০০৮ সালে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জির আন্দোলন ও ২৬ দিনের অনশনের ধাক্কায় বাংলা ছাড়তে হয়েছিল রতন টাটাকে। সিঙ্গুর থেকে কারখানা সরে গিয়েছিল গুজরাটে। পরবর্তী সময়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন, টাটাদের তিনি টাটা করেননি। কিন্তু স্মৃতি আর নথি যে বড় বেয়ারা। অতীতের সেই নথিই মনে করায়, সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর আন্দোলনের সমর্থনে মমতার পাশে প্রথম থেকে ছিল বিজেপি এবং আরএসএস। মমতাকে সমর্থন করতে অনশন মঞ্চে এসেছিলেন বিজেপি’র প্রথম সারির নেতা রাজনাথ সিং। আজকের বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী সেইসময় ছিলেন সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর আন্দোলনে মমতা ব্যানার্জির প্রধান সেনাপতি। সেদিন বাংলায় মমতার কারখানা বিরোধী আন্দোলনকে পদ্ম শিবির এবং আরএসএস সমর্থন করলেও রতন টাটা কিন্তু ন্যানো গাড়ির কারখানা খুলেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাটেই।বাংলা ছেড়ে যাওয়ার সময় রতন টাটা বলেছিলেন, ব্যাড ‘এম’-র পরিবর্তে তিনি বেছে নিলেন গুড ‘এম’-কে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো শিল্পবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্বের পথে উত্থান ঘটে মমতার। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও রাজ্যের ঝুলিতে আসেনি কোনও বড় বিনিয়োগ। ক্রমশই মন্থর হয়েছে রাজ্যের অর্থনীতির চাকা।

জেসপ-গেস্টকিন-ডানলপের মতো বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা। ধুঁকছে চা ও পাটশিল্প। এখনও জিন্দালের ইস্পাত কারখানার মুখ দেখেনি বাংলা। স্পেনে গিয়ে আচমকা শিল্পপতি বনে যাওয়া সৌরভ গাঙ্গুলিও বাংলাকে শিল্প দিতে ব্যর্থ। কলকাতা থেকে সরে গিয়েছে বহু কারখানার প্রধান কার্যালয়। তারাতলায় ব্রিটানিয়া কোম্পানির ভবিষ্যৎ আজ ধোঁয়াশায়। আসলে ১৩ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীর তৈরি করা ৭৫/২৫- বখরার হিসাব আর শাসকদলের প্রচ্ছন্ন মদতে রাজ্যজুড়ে জাল বিস্তার করেছে সিন্ডিকেট, তোলাবাজি। যা বাংলায় শিল্প বিস্তারে অন্যতম বড় বাধা। নিজের সেই প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে শিল্প ও শিল্পপতিদের থেকে শিল্পীদের প্রতিই বেশি মনোযোগী হয়েছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। একসময় সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য বণিকসভার বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে মমতার আমলে বাংলায় শিল্পের ভবিষ্যৎ বিশ বাঁও জলেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সীতারমন বলছেন, ‘শিল্প উৎপাদনে দেশে বাংলার শেয়ার ২৪ থেকে কমে ৩.৫ শতাংশ হয়েছে’। পাশাপাশি বাংলায় কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক ও চাকরিজীবীরা। তবে এতকিছুর পরেও হাল ছাড়েননি মমতা। কাশফুল দিয়ে সজ্জা তৈরি, চা ও চপ ভাজা বিক্রিকে শিল্পের সারিতে বসিয়ে রাজ্যে শিল্পায়নের নয়া সংজ্ঞা তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একইসঙ্গে রাজ্যবাসীকে মেলা আর উৎসবে মুড়ি-ঘুগনি-চপ বিক্রি করে দশতলা বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ফলে বছর বছর শিল্প সম্মেলন করা মমতার সরকারের অর্থনীতির একমাত্র আশ্রয় খেলা -মেলা আর উৎসব।
