লেখনী – অনিন্দ্য রায় চৌধুরী (আইনজীবী ও কংগ্রেস মুখপাত্র)
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রশাসনিক আশ্বাসের পর অনশন প্রত্যাহার করে নিলেন আর জি করের জুনিয়ার চিকিৎসকরা। স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন, তিলোত্তমার বিচার চেয়ে জুনিয়ার ডাক্তারদের যে আন্দোলনে বাংলার মানুষ সামিল হয়েছিলেন, সেই আন্দোলনে অভয়ার জাস্টিসের ভবিষ্যৎ কি? পরবর্তীকালে কোন পথে যাবে আন্দোলন? এই আলোচনায় আসার আগে এই ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে আনা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিচারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের সেরার শিরোপা অর্জন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের স্তুতি গাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা। উল্টোদিকে, অতীতে হয়ে যাওয়া সব মেডিক্যাল পরীক্ষার খাতা তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থার আধিকারীকদের হাতে তুলে দিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের দুর্নীতির অভিযোগে কার্যত মান্যতা দিচ্ছেন খোদ রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ কেমন উলট-পুরাণ। যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাংলা সেরার সেরা হবে, তবে কেন দুর্নীতির পাহাড় প্রমাণ অভিযোগের চাপে কঙ্কালসার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুনর্জ্জীবিত করতে ১০ দফা দাবি নিয়ে জুনিয়ার চিকিৎসকদের এত আন্দোলন? তাঁদের অপূরণীয় দাবি যে অমূলক নয়, তা তো মানছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। তাহলে জুনিয়ার চিকিৎসক এবং তাঁদের সমর্থন জানিয়ে সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ থামবে কেন?
যদি স্বাস্থ্যসচিব ও তাঁর দপ্তর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মেডিক্যাল কাউন্সিল, হেলথ ইউনিভার্সিটি, রিক্রুটমেনট বোর্ডের এই পচাগলা অবস্থা তৈরি হত না। হয়তো বা অভয়াকে জীবনটা দিতে হত না। এই কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। তাহলে কেন স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবি মেনে নিলেন না মুখ্যমন্ত্রী?
নবান্নে জুনিয়ার চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করে স্বাস্থ্য দপ্তরে দুর্নীতি অভিযোগে কার্যত সিলমোহর দিলেও এই দুর্নীতি দায় থেকে সুকৌশলে নিজেকে সরিয়ে আনলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। উল্টে যতটা সম্ভব মেডিক্যাল কলেজগুলোর ঘাড়ে দায় চাপালেন। একদিকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অচলাবস্থার জট কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের প্রতি অভিভাবকোচিত সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে, শাসকদলের একাধিক মুখপাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন। যা নিয়ে এখনও কোনও মুখপাত্রর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেননি তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, নির্দোষ কাউকে প্রমাণ ছাড়া অভিযুক্ত বলা যায় না৷ সেই যুক্তিতেই কি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে হাসপাতালের সেইসময়ের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে জিজ্ঞাসাবাদেরও প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি কলকাতা পুলিশ? উল্টে বদলি করে সন্দীপকে ‘পুরস্কৃত’ই করা হয়েছিল। যদিও সেই সন্দীপ ঘোষকেই অভয়া হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করেছে সিবিআই। শুধু তাই নয়, সেইসময় আর জি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের নির্দেশেই সেমিনার রুমের দেওয়াল ভাঙা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশের সামনেই প্রমাণ লোপাট করতে হাসপাতালে হামলা চালানো হয়েছিল। সব বিষয় মুখ্যমন্ত্রী মৌনই ছিলেন। এতকিছুর পর রাজ্যের এহেন প্রশাসনিক প্রধানের প্রতিশ্রুতিতে একটি আন্দোলনের শরীরী ভাষার সম্পূর্ণ পরিবর্তন কীভাবে আশা করছে প্রশাসন?

আসলে ছাবিশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে ব্যাকফুটে থাকা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, যাতে আন্দোলন নিয়ে একটি রাজ্যের ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সরকারের ‘নমনীয়‘ ভাবমূর্তি প্রকাশ্যে আনা যায়। কারণ অভয়ার বিচারের দাবি এখন জনতার দাবি। একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন চেয়ে যখন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে জনগণ পথে নামে, তখন সেই রাজ্যের সরকারের প্রতি সাধারণের আস্থা নিয়েই যে প্রশ্ন ওঠে। গণতন্ত্রে জনতাই দেবতা। জনতার দাবি মান্যতা দেওয়া গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম ধর্ম। দেশের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষ। তাই অভয়ার দোষীদের সাজা ঘোষণা সময়ের অপেক্ষা। ১২ বছরের শাসনে বাংলাকে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরে পরিণত করেছে মমতার সরকার। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, প্রশাসন, সর্ব স্তরে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই জারি। অভয়ার হত্যার বিচারের দাবি এবং জুনিয়ার চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন করে বাংলার মানুষ আজ শাসকের দুর্নীর্তির জাল ছিঁড়তে মরিয়া। তাই রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিচ্ছুরণ ঘঠছে। অভয়া খুনের বিচার সহ একাধিক দাবিতে জুনিয়ার চিকিৎসকদের আন্দোলন ক্রমশ স্বৈরাতন্ত্রের পাঁকে ডুবতে থাকা বাংলায় ঠিক যেন ‘ধেয়ানে আলোকরেখা’। এই আন্দোলন বাংলায় ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক স্ফুলিঙ্গ। যার তীব্রতা এবং তিলোত্তমার দোষীদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া বাংলায় মমতার সরকার পতনের অন্যতম কারণ হবে। মানুষের গায়ে কোনও রাজনৈতিক রং থাকে না। তবু আম জনতা যখন প্রতিবাদ করতে পথে নামে, তখন সেই আন্দোলনের জোর কতখানি হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছে আর জি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার চেয়ে জনগণের স্বস্তঃস্ফুর্ত আন্দোলন।

সম্প্রতি জুনিয়ার চিকিৎসকরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নবান্নে বৈঠক করা পর তাঁদের অনশন তুলে নিয়েছেন। যেকোনও আন্দোলনেরই চূড়ান্ত পর্যায় অনশন। সেই অনশন প্রত্যাহার করায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, অভয়া কি আদৌ বিচার পাবে? যার তদন্ত বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। দোষীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত করছে সিবিআই। ফলে অভয়ার বিচার পেতে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জুনিয়ার চিকিৎসকদের অনশন প্রত্যাহার কি ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ তথা নির্ভয়ার বিচারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনকে মন্থর করবে?

ছাবিশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে ব্যাকফুটে থাকা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারই ফলস্বরূপ, নবান্নে অনশনকারীদের নিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং করে বৈঠক করলেন তিনি। যাতে আন্দোলন নিয়ে একটি রাজ্যের ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সরকারের ‘নমনীয়‘ ভাবমূর্তি প্রকাশ্যে আনা যায়। কিন্তু কেন্দ্রের থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেরা বাংলা, এই তকমা আদায় করে নেওয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সামনে বসে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াটাও অনশনকারী চিকিৎসকদের বড় জয়। আন্দোলনের ৭১দিন পার হওয়ার পর চিকিৎসদের নিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং করা বৈঠকের মধ্য দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানলেন এবং মানলেন, যে বাংলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। তারপরেও দুর্নীতি দায় থেকে সুকৌশলে নিজেকে সরিয়ে যতটা সম্ভব মেডিক্যাল কলেজগুলোর ঘাড়ে দায় চাপালেন তিনি। পাশাপাশি দুর্নীতির আঁতুড়ঘরের মূল চক্রীর নাম প্রকাশ্যের আতঙ্কেই হয়তো স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবি মেনে নিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর জুনিয়র চিকিৎসকরা অনশন তুলেছেন এ কথা সত্য। কিন্তু তাতে করে নির্ভয়ার বিচারের দাবি নিয়ে চলা আন্দোলনের শরীরী ভাষার পরিবর্তন হয়ে যাবে, রাজ্য সরকার বা শাসকদলের এমনটা ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আর ‘অভয়া’ যাতে না হয় তার জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। গণতান্ত্রিক পরিবেশ জরুরি। তাই এই আন্দোলন এখন আর শুধুমাত্র চিকিৎসক সমাজের নয়। এই আন্দোলন এখন আপামর জনগণের। আসলে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় নিশ্চিন্ত হচ্ছেন এই ভেবে, যে তাঁর শাসনে রাজ্যের ‘উন্নত’ অর্থনীতির কারণে বাংলায় সরকারি দাক্ষিণ্য, নানা প্রকার সুবিধা ইত্যাদির থেকে পুরোপুরি মুক্ত একটি নাগরিক সমাজ কল্পনা করা খুবই কঠিন। তাই মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারণা, সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভে দমিয়ে রাখাও সম্ভব। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কলকাতায় ন্যায় বিচারের আন্দোলন বোধ হয় এই ধারণাকে বদলে দিতে পেরেছে। সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে নৈতিক অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছে যে মানুষ, তারা সবাই সরকারি প্রভাব বা দাক্ষিণ্য বা নির্ভরশীলতা যাই বলুন না কেন এসব কিছু থেকে মুক্ত তা একেবারেই নয়। তবু সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে শামিল। সমাজে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত নামি-দামি মানুষ সহ আপামর জনতা এই ন্যায়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে চলেছে। আর জি করে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে রাজ্য ঘটে চলা ভুরি-ভুরি দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অরাজকতা নিয়ে আজ শাসকের কাছে জবাব চাইছে সাধারণ মানুষ। কারণ নির্ভয়া আন্দোলনকে ঘিরে চর্চায় আশা থ্রেট কালচার, অর্থাৎ বেনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই সর্বনাশ, এইটাই বোধহয় সেই সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় বিপদ। আর তাই অভয়ার বিচারের দাবিতে এই আন্দোলন থামবে না। থামবে না দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের দাবিতে আন্দোলন। এই আন্দোলন নাগরিক আন্দোলন হয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, যা শাসকের ভীত নড়িয়ে দিতে যথেষ্ট হবে।